কিডনিতে পাথর হওয়ার লক্ষণ ও কারণ
কিডনিতে পাথর একটি খুবই গুরুতর সমস্যা। বিভিন্ন কারণে কিডনিতে পাথর হতে পারে। রেনাল ক্যালকুলি কিডনি বা কিডনতে পাথর বা মূত্রনালীর মধ্যে একটি শক্ত, স্ফটিক খনিজ পদার্থের পদার্থের গঠনকে বোঝায়।পাথরের অবস্থানের উপর নির্ভর করে এর আরো কয়েকটি নাম দেওয়া যায়। যেমন:নেফ্রোলিথিয়াসিস (কিডনিতে পাথর থাকে ),
ইউরোলিথিয়াসিস (মূত্রনালী বা মূত্রাশয় পাথর থাকে), ইউরোটেরোলিথিয়াসিস (পাথর মূত্রনালিত অবস্থান করে)। কিডনিতে পাথর হওয়ার লক্ষণ ও কারণ, কিডনির পাথর প্রতিরোধের উপায় জানতে হলে পুরো আর্টিকেলটি মনোযোগ দিয়ে পড়ুন।
ভূমিকা
কিডনি হচ্ছে শরীরের রক্ত পরিশোধনকারি অঙ্গ। কিডনি হচ্ছে মানবদেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। দেহ সুস্থ রাখার জন্য ও বেঁচে থাকার জন্য একটি অপরিহার্য অঙ্গ হচ্ছে কিডনি। কিডনি প্রধানত বর্জ্য পদার্থ, অতিরিক্ত পানি এবং অন্যান্য ক্ষতিকারক পদার্থ পরিশোধন করে।কিডনির অন্যতম প্রধান কাজ হল লবণ ও পটাশিয়ামের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা, হরমোন তৈরি করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা, লাল রক্ত কোষের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করা এবং ক্যালসিয়াম শোষণে সহায়তা করা। বিভিন্ন কারণে কিডনিতে পাথর হতে পারে। কিডনিতে পাথর হওয়ার লক্ষণ ও কারণ সম্পর্কে আমাদেরকে অবগত থাকতে হবে।
কিডনিতে পাথর কত প্রকার
অবস্থান ও গঠনের উপর ভিত্তি করে পাথর কয় এক প্রকার হতে পারে। যেমন :
- ক্যালসিয়াম অক্সালেট পাথর
- ক্যালসিয়াম ফসফেট পাথর
- ইউরিক এসিড পাথর
- সিস্টাইন পাথর
কিডনিতে পাথর হওয়ার কারণ
কিডনিতে পাথর তৈরি হয় যখন পাথর গঠনকারী পদার্থ (লবন) প্রসাবে নিগত হয়। কিডনিতে পাথর হওয়ার লক্ষণ ও কারণ রয়েছে অনেক গুলো। প্রসাবে সংমিশ্রণে পরিবর্তন বা প্রসাবের পরিমাণ হ্রাস গঠনের সহায়তা করে এই ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টিকারী কিছু কারণ গুলোর মধ্যে রয়েছে,
- কিছু খারাপ খাদ্য অভ্যাস (উচ্চ প্রোটিন গ্রহণ অত্যধিক, লবণ বা চিনি, ভিটামিন ডি সম্পূরক দীর্ঘক্ষণ গ্রহণ, অতিরিক্ত পালং শাক খাওয়া, বেশি অক্সালেট যুক্ত খাবার)।
- কঠোর ব্যায়াম বা কম তরল গ্রহণের কারণে ডিহাইড্রেশন হলে।
- বিপাকের অস্বাভাবিকতার কারণে প্রসাবের সংমিশ্রণে পরিবর্তন।
- প্রসাবের বহিঃপ্রবাহে যেকোনো ধরনের বাধা।
- মূত্রনালীতে সংক্রমণ।
কাদের কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে
যেকোনো বয়সের মানুষের কিডনিতে পাথর হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। ছোট বড় যে কোন বয়সের মানুষের কিডনিতে পাথরের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে কিছু গোষ্ঠীর লোকেদের কিডনিতে পাথর হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এদের মধ্যে রয়েছে ;
- পুরুষদের
- গর্ভবতী মহিলাদের
- ২০ থেকে ৫০ বছর বয়সী মানুষদের
- পরিবারের সদস্যদের কিডনিতে পাথর রয়েছে এমন মানুষদের
- অ্যান্টাসিড, মূত্রবর্ধক ইত্যাদির মতো নির্দিষ্ট ওষুধ গ্রহণ কারী লোকেদের।
- অতিরিক্ত পরিমাণে ব্যথা নাশক ওষুধ গ্রহণকারী মানুষদের।
- যাদের কিডনিতে পাথর পূর্ব ইতিহাস রয়েছে।
- নির্দিষ্ট কিছু রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং চিকিৎসার অবস্থান হাইপারক্যালসিউরিয়া, হাইপারপারোথাইরেডিজোম, গাউট, ডায়াবেটিস, ইউরিক এসিডের মাত্রা বৃদ্ধি।
কিডনি রোগের উপসর্গ গুলো কি কি
কিডনিতে পাথর হওয়ার কারণ কি ও কি কি লক্ষণ দেখা যায়? এই প্রশ্ন অনেকের মনে জাগে। উত্তর হলো কিডনিতে পাথরের সমস্যা দেখা দিলে রোগীর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের লক্ষণ দেখা যায়। আবার কিছু কিডনি পাথর 'নীরব পাথর' হিসেবে পরিচিত কারণ তারা কোন উপসর্গ সৃষ্টি করে না। কিডনিতে পাথরে
আক্রান্ত ব্যক্তিরা কখনো কখনো কোলিক ব্যথা বা রেনাল কলিক রিপোর্ট করেন, যা নিম্ন পিঠে বা কুঁচকির অঞ্চলে হঠাৎ অসহনীয় ব্যথা এবং সাথে বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে। এই ক্ষেত্রে শরীরের ভঙ্গি পরিবর্তন করে ব্যথার উপসরণ হয় না। কিডনিতে পাথর হলে পুরুষ এবং মহিলাদের কিছু অতিরিক্ত উপসর্গ থাকতে পারে যার মধ্যে রয়েছে,
- মূত্রনালীতে সংক্রমনের কারণে জ্বর বা ঠান্ডা লাগা
- প্রসব করতে অসুবিধা হওয়া বা প্রসাবের জরুরীতা
- তলপেটে এবং কুঁচকির দিকে প্রসারিত ব্যথা
- পুরুষদের পেনাইল বা টেস্টিকুলার এলাকায় ব্যথা
- প্রসবের রক্তের উপস্থিতি (হেমাটুরিয়া)
- প্রসাবের সময় তলপেটে ব্যথা
- মাজায় অতিরিক্ত ব্যথা।
- প্রসাবের সময় জ্বালাপোড়া হওয়া
- ওজন কমে যাওয়া
- শরীরে ক্লান্তি ভাব আসা
- শরীরে বিভিন্ন অংশে চুলকানি বা র্যাশ হওয়া
কিডনি রোগের লক্ষণ
কিডনিতে সমস্যা দেখা দিলে শরীরে বেশ কিছু রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। আবার অনেক সময় কোন সমস্যা সহজে বোঝা যায় না। তবে নিচের লক্ষণগুলো দেখা দিলে অতি দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।লক্ষণগুলো হলো :
- বারবার মুখের সঙ্গে রক্ত বের হওয়া পা মুত্রে অতিরিক্ত ফেনা হওয়া।
- প্রসাবে জ্বালাপোড়া।
- পিঠের নিচের অংশ ব্যথা হওয়া।
- ত্বকে চুলকানি ও র্যাশ হওয়া।
- শ্বাসকষ্ট হওয়া
- গরম আবহাওয়ার মধ্যে শীত অনুভব হওয়া।
- মুখ চেহারার চারপাশ ও পায়ের গোড়ালি ফুলে যাওয়া।
- খাবারে অরুচি ও মুখে দুর্গন্ধ হওয়া।
কিডনিতে পাথরের চিকিৎসা
কিডনিতে পাথর হওয়ার লক্ষণ গুলো ও কারণ গুলো জানা থাকলে চিকিৎসা নেওয়া সহজ হয়। কিডনিতে পাথরের সমস্যা দেখা দিলে সর্বপ্রথম চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে । কিডনিতে পাথর নির্ণয় করা হলে নেফ্রোলজিস্ট পাথরের আকার উপসর্গ এবং চিকিৎসা এর উপর নির্ভর করে উপযুক্ত চিকিৎসার পরামর্শ দিতে পারেন। আল্টাসনোগ্রাফির মাধ্যমে আগে পাথরের নির্ণয় করতে হবে। পাথরের
সাইজ যদি ৫ মি.মি এর কম হয় তবে তবে চিকিৎসকের পরামর্শে কিছু ওষুধ খেলে খুব দ্রুত কিডনি থেকে পাথরটি মূত্রের মাধ্যমে অপসারণ হয়ে যায়। আর যদি পাথরের সাইজ ৫ মি.মি এর বেশি হয় তবে দীর্ঘদিন চিকিৎসার মাধ্যমে বা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ করা হয়।এটি দুই ভাবে হতে পারে।
১.ইউরোটেরোস্কোপি - এরেটার বরাবর এটিটিউড ঢুকিয়ে ডাক্তার দ্বারা ছোট কিডনি পাথর অপসারণ করা যেতে পারে ডাক্তার তাদের দ্রবীভূত করতে এবং ভেঙে ফেলার জন্য ইউরেটোরোস্কোপের মধ্যে লেজার ব্যবহার করে পাথর অপসারণ করা যায়।
২.ওপেন সার্জারি - কিডনির পাথর অপসারণের জন্য ওপেন সার্জারি বা অপারেশন খুবই কম এখন আর ব্যবহার হয় না। পাথর আটকে গেলে, প্রসাদ প্রবাহে বাঁধা, রোগীর অবস্থা গুরুতর হলে (যেমন প্রচন্ড ব্যথা এবং রক্তপাত হলে) ডাক্তার ওপেন সার্জারি করার পরামর্শ দিতে পারে।
কিডনির পাথর প্রতিরোধের উপায়
কিডনিতে পাথর প্রতিরোধের জন্য সর্বপ্রথম খাদ্যের কিছু পরিবর্তন ও পর্যাপ্ত পানি পান এর বিকল্প নেই। একবার কিডনিতে পাথর হলে পরবর্তীতে আশঙ্কা খুব বেশি দেখা যায়। তাই যাদের একবার কিডনিতে পাথর হয়েছে তাদেরকে অবশ্যই কিছু পরামর্শ মেনে চলতে হবে। এবং মাথায় রাখতে হবে কিডনিতে
পাথর হওয়ার লক্ষণ ও কারণ সম্পর্কে।কিডনির সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ হলো পর্যাপ্ত পানি পান করা যাতে শরীর শুষ্ক না থাকে। এখন প্রশ্ন হলো কতটুকু পানি করব? এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করবে আপনার শরীরের উপর, কাজের ধরন, অবস্থান ও জলবায়ুর উপর। কেউ যদি
বেশি পরিশ্রমে হয় তাহলে তার জন্য বেশি পানি করা প্রয়োজন। আবার কেউ যদি তেমন পরিশ্রম না করে তাহলে তার জন্য পানির প্রয়োজন তুলনামূলক কম। গ্রীষ্ম প্রধান অঞ্চলে বা গ্রীষ্মকালে শীতপ্রধান অঞ্চলের বা শীতকালে পানির প্রয়োজন বেশি হবে। যাদের আগে পাথর হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এমন পরিমাণ পানি ও তরল পান করতে হবে যাতে প্রসাব ২৪ ঘন্টায় ২ লিটার মতো হয় অথবা প্রসাব উচ্চ বর্ণের না হয়। যেন এটি দেখতে অনেকটাই পানির মতোই হয়। অবস্থান ভেদে ২-৪ লিটার পানি পান করার প্রয়োজন হতে পারে।
- খাদ্যে লবনের পরিমাণ কমাতে হবে।
- কোন অসুখের কারণে প্রসব প্রবাহে বাধা অথবা সংক্রমণ থাকলে তার চিকিৎসা করাতে হবে।
- কিডনি বা মূত্রতন্ত্র থেকে পাথর বের করার পর পাথরের রাসায়নিক পরীক্ষা করে দেখতে হবে। ক্যালসিয়াম অক্সালের পাথরের ক্ষেত্রে যেসব খাদ্যে অক্সালেট বেশি থাকে তা কম খেতে হবে । যেমন পালং শাক, স্ট্রবেরি, মাখন, দুগ্ধ জাতীয় খাবার ইত্যাদি। প্রসাবে সাইট্রেট কম থাকলে পটাশিয়াম সালট্রেট খেতে হবে। এটি প্রসাবে অ্যাসিডোসিস কমায়। অজ্ঞত কারণে ক্যালসিয়াম বেড়ে গেলে মুত্রবর্ধক থায়াজাইড জাতীয় ওষুধ খাওয়া যেতে পারে।
- মেটাবলিক সমস্যার জন্য পাথর হলে তার চিকিৎসা করাতে হবে। তারা থাইরয়েড কার্যকার টিউমার থাকলে শল্য চিকিৎসা করাতে হবে।
উপরে আমরা কিডনিতে পাথর হওয়ার লক্ষণ ও কারণ সর্ম্পকে জানলাম। কারো মধ্যে এই সমস্যাগুলো দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসা করাতে হবে।
লেখকের মন্তব্য
কিডনিতে পাথর হওয়ার লক্ষণ ও কারণ সর্ম্পকে ইতোমধ্যে আমরা অবগত হলাম। কিডনিতে পাথর হওয়ার লক্ষণগুলো যদি প্রকাশ পায় তাহলে অতিসত্বর চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে ও যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসা শুরু করতে হবে কারণ কিডনির সমস্যার চিকিৎসা না করালে মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় অনেক রোগীর অবহেলার কারণে কিডনি বিকল হয়ে মারা যায়। তাই চিকিৎসার কোন বিকল্প নেই। এতক্ষণ আর্টিকেলটি পড়ার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। এরকম আরও তথ্য পেতে আমাদের ওয়েবসাইটের সাথেই থাকুন।
https://www.dyinamicit.com/p/blog-page_16.html
comment url